অনেক দিন ধরে হাজার হাজার কিশোরী-তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও আদায়ের পাশাপাশি অর্থ দাবি করতো ‘পমপম’ নামে একটি আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম গ্রুপ। এ ছাড়াও এসব ছবি-ভিডিও বিক্রি করে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিয়েছে। সেই চক্রটির মূলহোতাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তারের পর এমনটিই জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আজ সোমবার (২২ মে) দুপুরে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া এ তথ্য জানান। গ্রেপ্তাররা হলেন- ‘পমপম’ গ্রুপের মূলহোতা মার্ক-সাকারবার্গ ওরফে আবু সায়েম, শাহরিয়ার আফসান অভ্র, বোগদাদী শাকিল, ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান, মো. জসীম, ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, অভিভাবকদের রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজের কথা বলতেন ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরী-তরুণীরা। অভিভাবকরা নিশ্চিতে থাকতেন তাদের সন্তান ফ্রিল্যান্সিং করছেন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ের আড়ালে তারা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি-ভিডিও দিতে বাধ্য হতেন।
এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের টেলিগ্রাম গ্রুপে তাদের গোপন ছবি ও ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ দাবি করতো। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিওকলে এসে আপত্তিকর দৃশ্য করতে বাধ্য করতো। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিতো চক্রটি।
সিআইডি প্রধান বলেন, গ্রুপটি পটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরালের ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কেবল টাকাই নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। মাসে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে বাহিরের কয়েকটি দেশের অসংখ্য ক্রেতা পমপম গ্রুপটির সদস্য হয়েছেন। তারা অল্পবয়সী মেয়েদর আপত্তিকর ওইসব কনটেন্ট কিনে সংরক্ষণ করেন। তিনি বলেন, চক্রটির মূলহোতা মার্ক-সাকারবার্গ নামের এক ব্যক্তি। মার্কের আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম চট্টগ্রামে থাকেন।
আইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। সিআইডি প্রধান বলেন, এরই মধ্যে এক ভুক্তভোগী তার এবং তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেওয়ায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করেন। এ মামলা তদন্তে করতে গিয়ে প্রথমে তাকে পরে তার সহযোগীদের চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিআইডি বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কনটেন্ট দিতেন পমপম গ্রুপে। অর্থাত্ সুসময়ের প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তারা ক্যামেরাবন্দি করেছেন সেগুলোই দিতেন মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার অ্যাডমিনদের দিয়ে সেসব ফেসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করতেন গ্রুপগুলোতে।
সিআইডি প্রধান বলেন, মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র ও শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় জানা গেছে। তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কনটেন্ট সংরক্ষণ করে রাখা এবং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কম্পানিতে চাকরি করেন। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সায়েম ও মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিআইডি প্রধান বলেন, এ অ্যাডাল্ট গ্রুপগুলোর অ্যাডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেটটুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দেওয়ায় একে একে গ্রেপ্তার করা হয় অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাটকে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
এ ঘটনায় মানিলন্ডারিং তদন্ত করারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সিআইডি প্রধান। কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, ফলো দ্য মানি করে তাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।